আলামত সংগ্রহেই প্রাণ হারায় অনেক অপরাধ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৪, ০৩:০৪ পিএম

আলামত সংগ্রহেই প্রাণ হারায় অনেক অপরাধ

ফাইল ছবি

সব ঘটনাই দুর্ঘটনা নয়। কিছু দুর্ঘটনার পেছনে লুকিয়ে থাকে বড় ধরনের অপরাধ। প্রতিনিয়ত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজান অপরাধীরা। এমন ঘটনা বহু তদন্ত করেছে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা। এসব ঘটনার আলামত সংগ্রহে আধুনিক যন্ত্রপাতির কমতি রয়েছে থানা পুলিশের। এই দুর্বলতায় অনেক সময় অনিয়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে- থানা পুলিশের আধুনিক যন্ত্রপাতির কমতি থাকায় আলামত সংগ্রহে বিঘ্নতা ঘটতে পারে। তবে, এটিকে থানা পুলিশ আলামত নষ্ট করে ঢালাও ভাবে বলা ঠিক হবে না। অন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে আধুনিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা বেশি থাকাই দ্রুতই পাচ্ছে তদন্তে সফলতা। এছাড়াও, অনিচ্ছাকৃত ভাবে ও উচ্ছুক জনতারাও নিজেদের অজান্তেই নষ্ট করে আলামত।

অন্যদিকে, আলামত সংগ্রহে তদন্তকারী সংস্থার অনীহা, ইচ্ছাকৃত ভুল কিংবা ব্যক্তি বিশেষ বৈষম্যতার কথা বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর অনেক সফলতার গল্প তুলে ধরেই অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সব ঘটনায় দেওয়া হয়না সমান গুরুত্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বর্তমান বাংলাদেশকে বলেন, ‘পানিতে ভেসে আসা, অজ্ঞাত কিংবা পোঁচেগোলে যাওয়া মৃতদেহে হত্যার আলামত পেলেও দায়সাড়া মন্তব্য লেখে ঘটনা থেকে সরে আসার অজুহাত দেন কিছু সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।

ব্যক্তি বিশেষ বৈষম্যতার কথা তুলেধরে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘একই মরদেহ যদি সমাজের কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির হয়, তখন ঘটনার প্রেক্ষাপট অন্য হয়ে যায়। মানে তদন্তে আসে গতি। এতে, আলামত সংগ্রহে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও ব্যক্তিবিশেষ বৈষম্যতা দেখা দেয়। আলামত সংগ্রহে ব্যক্তিবিশেষ এই বৈষম্যতার কারণে অনিয়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা। আর স্পর্শকাতর হত্যার মত ঘটনা তখন হয়ে যায় অপমৃত্যু।’ 

মৃতদেহের আলমত সংগ্রহ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদন্নোতি প্রাপ্ত) আবু ইউসুফ বর্তমান বাংলাদেশকে জানান, ‘যেকোন দুর্ঘটনার ঘটনাস্থলের আশেপাশের বা মৃতদেহের আলামত সংগ্রহ করার সময় নজর রাখতে হবে যেন কোন কিছু ছাড়া না পরে। কারণ, অনেক সময় আলামতের ওপর নির্ভর করে মামলার তদন্ত। সেজন্য গুরুত্বসহকারে সংগ্রহ করা দরকার।

আলামত নষ্ট বা পাওয়া যায়নি বলে দায়সারা তথ্য পেশ করেন থানা পুলিশ এমন অভিযোগ করেন অনেক ভুক্তভোগীরাও। এই বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নে ইউসুফ বলেন, “আলামত নষ্ট হয়েছে বিষয়টা এভাবে না বলি। থানা পুলিশের কাছে আলামত সংগ্রহের পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকাই অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। তদন্তে ধীরগতি বলতে পারেন।’

আলামত নষ্ট তবুও সফল তদন্ত:

মাত্র ছয় শব্দের চিরকুটে বেরিয়ে আসে ২ মাস বয়সি শিশু ইমাম হত্যার আসল রহস্য। চিরকুটে লুকানো ছিল শিশু ইমাম চুরি হয়েছিল কিনা হত্যা হয়েছিল। ওই চিরকুটের সূত্র ধরেই পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে। কিন্তু এই ঘটনায় ব্যর্থ হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের বন্দরথানা থানা পুলিশ।

ইমামের মা যা করেছিল সেই রাতে:

সেইরাতে ১২টার দিকে মা মরিয়ম নিজের ছেলেকে ঘুমন্ত অবস্থায় পুকুরে ফেলে দেয়। পরে নিজেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে। বলতে, থাকে ইমামকে কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেছে। কিন্তু দু’দিন যেতেই ইমামের মায়ের লুকোচুরিতে ভাঁটা পরে যায়। পুকুরে ভেসে ওঠে ইমামের মরদেহ। ২০২২ সালের ১৯ মার্চ। ওই রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দরথানা এলাকায় ঘটেছিল এমন ঘটনা।

অনেক বছরের পুরনো মামলা পিবিআই কিভাবে আলামত সংগ্রহ করে এই প্রশ্নে পিবিআই কর্মকর্তা ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের (পিবিআই) বা পুলিশের অন্য তদন্তকারী সংস্থার কাছে আধুনিক যান্ত্রপাতির সংখ্যা বেশি থাকাই সহজেই কোন ঘটনার সত্যতা বের করতে সক্ষম হই।’

আলামতের কারণে থানা পুলিশ ব্যর্থ হওয়ার পর এমন কয়টি মামলা পিবিআই   তদন্তে সফলতা পেয়েছে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ বলেন, ‘এইটার সঠিক কোন তথ্য নেই; আর আমার মনে হয় এই তথ্য কারও কাছে আছে বলে মনে হয়না।’

বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন প্রকার আলামত ছাড়াই ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ২০-২৫ বছর পরও মৃত্যের রহস্য উদ্ঘাটন করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

আলামতের অজুহাত বা নষ্ট প্রসঙ্গে অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন ভিন্নকথা। আলামত সংগ্রহ কিংবা নষ্ট প্রসঙ্গে ভিন্নভাবে উপস্থান করা হচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বর্তমান বাংলাদেশকে জানান, ‘নদীতে ভেসে আসা অজ্ঞাত লাশ, ট্রেনে কাটা, বা কোন স্থানে পড়ে থাকা মৃতদেহটি পোঁচেগোলে পরে আছেন। এগুলোর আলামত সংগ্রহে তদন্তকারী কর্মকর্তারা গভীর ভাবে খুঁজে দেখার মানসিকতা দেখা যায় না। আবার কিছু ঘটনায় ব্যক্তি বিশেষ গুরুত্ব পেতে দেখাও যায়।

গুরুত্ব সহকারে আলামত সংগ্রহ কেন জরুরী:

আলামত সংগ্রহের ওপরে নির্ভর করে একটি মরদেহের সত্য ঘটনা। যা সংগ্রহ করা হয় সুরতহাল রিপোর্টের সময়। আর সেই আলামতের ওপরেই তৈরি করা হয়   ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। মর্গে আসার আগেই নষ্ট হয়ে যায় আলামত। এজন্য নায্য বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মৃত ব্যক্তির পরিবার। এক কথাই বলা চলে আলামত সংগ্রহের ওপরে নির্ভর করে অপরাধী ছাড় পাবেন না ধরা পড়বেন।

কি সংগ্রহ করা হয় আলামত বা সুরতহাল রিপোর্টে:

বিভিন্ন ধরনের অপরাধে বিভিন্ন ধরনের আলামত পাওয়া যেতে পারে, যেমন—রক্ত, বীর্য, প্রস্রাব, লালা, বমি, চুল, আঙুলের ছাপ, পায়ের ছাপ, দাঁতের চিহ্নর ছাপ, ওষুধ, আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ, ভিসেরা ও মরদেহের আশেপাশের মাটির বিভিন্ন অংশ। এছাড়াও, মোবাইল ফোন, হাতের আংটি, জন্মদাগ, গায়ের তিল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

আলামত নষ্টের অজুহাতের পেছনে যেগুলো কারণ হিসেবে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘মৃতদেহটি অনেক দিন ধরে পানিতে কিংবা কোন একটি স্থানে পরে ছিল। আলামতগুলো গুরুত্বের সঙ্গে সংগ্রহ না করে; অথবা অপরাধের ধরণ চি‌হ্নিত না করেই তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংস্থা প্রথমেই বলেন, আলামতগুলো নষ্ট হয়েছে বলেই দায় সারাতে ব্যবস্থ হয়ে পরেন।’

মৃতদেহের আলামত সংগ্রহে বৈষম্যতা:

আলামত সংগ্রহে বৈষম্যতার কথা তুলেধরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলছেন, ‘মৃতদেহটি যদি সমাজের কোন নামিদামি ব্যক্তির হয়ে থাকেন সেইক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায় তদন্তে। যেমন- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে পদক্ষেপগুলো ভিন্ন রকম হয়ে যায়। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি হলে, সেবাদানকারী বা রাষ্ট্রের সংস্থা গুলোর দৃষ্টিভঙ্গি একরকম হয়। মানে বলতে চাইছি, দ্রুত কাজ করার মানসিকতা দেখা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর প্রতিষ্ঠিত না হলে যদি দৃষ্টিভঙ্গি আরেক রকম হয়। তখন কিন্তু সমাজের বৈষম্যের প্রার্থক্যের কারণে একজন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হয়। তাতে কিন্তু অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তখন অনেক ক্ষেত্রে হত্যার মত ঘটনাগুলো থেকে আসল অপরাধীরা সহজেই বেরিয়ে যেতে পারেন।’

এমন ঘটনায় আলামত সংগ্রহকারী থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বর্তমান বাংলাদেশ।

তারা জানিয়েছেন, ‘অনেক সময় পেশাদার অপরাধীরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেটিকে আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চান। এজন্য আলামত সংগ্রহের সময় সচেতন হয়ে সবদিকে লক্ষ্য রেখে আলামত সংগ্রহ করা উচিত।’

আলামত নষ্ট কেন হয় জানতে চাইলে পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বর্তমান বাংলাদেশ জানান, “অনেক সময় অপরাধীরাই নষ্ট করেন। আবার আমাদের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় যদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খেয়াল না করি তখন এমন হতে পারে। তবে, আমরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব ঘটনা দেখার মানসিকতা রাখি। আর অন্য সংস্থার মত থানায় আধুনিক যন্ত্রপাতি কমতি থাকার কারনে চাইলেই সহজে কিছু করতে পারি না।’

জানাগেছে, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এমন অনেক আলামত নষ্ট হওয়া মৃতদেহকে হত্যা বলে দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই লাশেকেই থানা পুলিশ বলেছিলেন আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু।

আলামত সংগ্রহে তিনটি উৎস:

১. সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে ২. ভিকটিমের ক্রাইমসিন থেকে ৩. তার পরিবেশ থেকে। বাংলাদেশে ক্রাইমসিনে প্রধানত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থার  ফরেনসিক টিমের দক্ষ সদস্যরাই আলামত সংগ্রহ করেন। প্রয়োজনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।

ডিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ক্রাইম এ্যাণ্ড অপারেশন বিভাগ (অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) পদে পদোন্নতি) এ, কে,এম হাফিজ আক্তার জানান, “এমন যেকোন ঘটনায় আশেপাশে থাকা সাধারন জনতারাও হাত দিয়ে ধরে আলামত নষ্ট করে ফেলে। আবার অপরাধীরা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর ইচ্ছে করেই আলামত নষ্ট করেন। সেজন্য অনেক সময় তদন্তকারী কর্মকর্তার সঠিক তথ্য পেতে বা তদন্ত করতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তারপরেও আমাদের বাহিনীর সদস্যরা সঠিক তদন্ত করে মূল অপরাধকে চিহ্নিত করেন। 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: মোহাম্মদ জাহিদুল আরেফিন বলেন, ‘মর্গে আসার আগেই লাশের আলামত নষ্ট হয়ে যায়। অপ্রয়োজনীয় আলামত পাই। যা প্রয়োজন না। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যে ভাবেই বলেন না কেন, আলামত নষ্ট হলে সঠিক রিপোর্ট তৈরিতে ব্যেগ পেতে হয়। সেজন্য সঠিক পরীক্ষানিরীক্ষা করা কঠিন হয়ে পরে। তারপরেও আমরা সঠিক তদন্ত করি।’

 

ইএ

Link copied!